Header Ads

ডিমেনশিয়া, অবহেলা নয় সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন || Dementia, not neglect requires social awareness || Dr. Abida Sultana

ডিমেনশিয়া, অবহেলা নয় সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন, ডা আবিদা সুলতানা, Dementia, not neglect requires social awareness, Dr. Abida Sultana


ডিমেনশিয়া হচ্ছে জটিল নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ। এই রোগ হলে মানুষ ধীরে ধীরে তাঁর স্মৃতিশক্তি হারাতে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডিমেনশিয়া নিয়ে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ার উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল যেখানে দেখা গেছে বিশ্ব জুড়ে ৫৫ মিলিয়ন মানুষ এই রোগ নিয়ে বেঁচে আছেন এবং প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হু এর মতে এই রোগই হচ্ছে সপ্তম বৃহৎ মৃতু্যর কারণ। বাংলাদেশের ৭টি বিভাগে ২০১৯ সালে আইসিডিডিআর.বি এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স শহর ও গ্রাম মিলিয়ে ২ হাজার ৭৯৬ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে এই জরিপ চালায়। গবেষণার তথ্য বলছে প্রতি ১২ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়াতে আক্রান্ত। এক্ষেত্রে ৮ শতাংশ ডিমেনশিয়ার প্রভাব পাওয়া যায়। নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ শতকরা দুই দশমিক ৫ গুণ বেশি। সমীক্ষায় অনুমান করা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ডিমেনশিয়া রোগের সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন। তাদের মধ্যে ০.২৮ মিলিয়ন পুরুষ এবং ০.৮৮ মিলিয়ন নারী। একই গবেষণা দেখা গেছে, ২০২৫ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১.৩৭ মিলিয়নে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে (২.৪ মিলিয়ন)। যদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য স্নায়ুকোষ (নিউরন) নিয়ে গঠিত। নিউরন এর কাজ হলো বিভিন্ন উদ্দীপনা গ্রহণ করে প্রতিবেদন সৃষ্টি, মস্তিষ্কে যাবতীয় স্মৃতি সংরক্ষণ, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ও অন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয় সাধন ও পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। মানব মস্তিষ্কে ১০০ বিলিয়নের মতো নিউরন বা স্নায়ুকোষ আছে। নিউরন কোষগুলোর মধ্যে রাসায়নিক ও বৈদু্যতিক সংকেতের আদান প্রদানের ফলে আমরা হাসি, কান্না, স্বপ্ন দেখা, চিন্তা-ভাবনা, নড়াচড়া করতে সক্ষম হই। ডিমেনশিয়া হলে স্নায়ুকোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যে কারণে কার্যকরভাবে বার্তা প্রেরণ হয় না তাই মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হয়। ডিমেনশিয়া যে কোনো বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে, কিন্তু এটি সাধারণত ৬৫ বছরের অধিক বয়সি মানুষের হয় এমন ধারণা ছিল। কিন্তু এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন কম বয়সেও ডিমেনশিয়ায় ভুগতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও আরও একটি উলেস্নখযোগ্য কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা বা সচেতনতার অভাবে তা নির্ণয় করতে অনেক বেশি দেরি হয়ে যায়। আমাদের সমাজে ডিমেনশিয়ার বিষয়ে এখনো সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বয়স ৬৫ বা তার বেশি হলে ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান, শারীরিক দুর্বলতা, ভিটামিন ডি এর অভাব, অর্থোস্ট্যাস্টিক, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস. থাইরয়েড সমস্যা, বিষণ্নতা বা মানসিক অশান্তিতে ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ডিমেনশিয়া মূলত চিন্তা করার ক্ষমতা, আচরণগত অবস্থা, ব্যক্তিত্বের ধরনের উপর প্রভাব ফেলে, সাধারণ ডিমেনশিয়ায় বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা যায়:- ১। স্মৃতিশক্তির সমস্যা অর্থাৎ কোনো কিছু মনে রাখতে পারেন না। অতীত বা বর্তমানের কোনো ঘটনা বা কাজ মনে রাখতে পারেন না। ২। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অসুবিধা। ৩। আচরণগত পরিবর্তন হওয়ার কারণে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা দেখা যেতে পারে। ৪। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া। ডিমেনশিয়া শনাক্তকরণের জন্য নিউরোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট * ব্রেন ইমাজিং করা প্রয়োজন * রক্ত পরীক্ষা বিশেষ করে সুগার, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল, ভিটামিন বি১২ পরীক্ষাগুলো করানো খুবই প্রয়োজন। সর্বোপরি আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। ডিমেনশিয়ার ২০০ এর ওপর ধরন এবং কারণ আছে। ডিমেনশিয়ার সর্বাপেক্ষা সাধারণ চারটি হলো : * অ্যালজাইমার্স রোগ * ভাসকুলার ডিমেনশিয়া * ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া * লিউই বডি ডিমেনশিয়া। আরেকটি উলেস্নখ্যযোগ্য ডিমেনশিয়া হলো সিউডোমেনশিয়া। সিউডোমেনশিয়া জ্ঞানীয় প্রতিবন্ধকতা যা ডিমেনশিয়া অনুকরণ করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেজাজ- সম্পর্কিত মানসিক স্বাস্থ্য উদ্বেগের কারণে ঘটে থাকে। তা হলো বিষণ্নতা। এই অবস্থাটি সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। সিউডোমেনশিয়ার সাধারণ লক্ষণগুলো হলো: * স্মৃতি সমস্যা * মনোযোগ এবং একাগ্রতা কমে যাওয়া * সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা * কথা বলার সাবলীলতা কমে যাওয়া * মন মেজাজের পরিবর্তন * বক্তৃতা এবং ভাষার ঘাটতি। সিউডোমেনশিয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে # লিঙ্গ (মহিলাদের পরিসংখ্যানগতভাবে বিষণ্নতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি) # পারিবারিক ইতিহাস # বিবাহবিচ্ছেদ # নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা। সব বয়সের মানুষই বিষণ্নতা অনুভব করতে পারে কিন্তু সিউডোমেনশিয়া সাধারণত মধ্যবয়সি বা তার বেশি বয়সের প্রাপ্তবয়সকদের মধ্যে দেখা যায়। দ্রম্নত রোগ নির্ণয়সহ চিকিৎসা ও পরিচর্যা পেলে রোগী সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে


ডিমেনশিয়া রোগীদের খাবার বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ বছরে যারা চিনি, লবণ ও স্নেহপদার্থ যুক্ত খাবার বেশি খেয়েছেন তারা ডিমেনশিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। কম প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলেও বাড়ে ডিমেনশিয়া রোগের ঝুঁকি, ডিমেনশিয়ার আশংকা বাড়ায় ঠান্ডা পানীয়, আইসক্রীম, ডুবোতেলে ভাজা মাংস, ডিপ ফ্রায়েড খাবার, সস, প্রক্রিয়াজাত পাউরুটি ও প্যাকেটজাত খাবার। চিজ, কেক, টেস্টিং সলট, পনীর, সয়াসস খাদ্য তালিকায় না রাখাই ভালো। খাদ্যের তালিকায় রাখতে পারেন আঙ্গুর, জাম, দারুচনি, মধু, বাদাম, হলুদ, মাছ, আমলকি, ডালিম। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা শস্যদানা, গাজর, সবুজ শাক সবজি এবং ছোলা, ব্রকলি, স্ট্রবেরির মতো উন্নত মানের খাবার খান তাদের মধ্যে হতাশার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ কম। রেডমিট বা চর্বিযুক্ত মাংস সপ্তাহে ৩ দিনের বেশি না খাওয়াই ভালো।


ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে আমাদের প্রত্যেকের করণীয় : ১. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শাক-সবজি ও ফলমূল রাখতে হবে। ২. হাইড্রেটেড থাকা বা শারীরে তরলের যথাযথ মাত্রা বজায় রাখতে হবে। ৩. নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। ৪. ধূমপান, মদ্যপান ও কোনো রকম আসক্তি জাতীয় পদার্থ গ্রহণ পরিহার করতে হবে। ৫. বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন রাখা প্রয়োজন। ৬. সময় পেলে নিজের শখের কাজগুলো করা প্রয়োজন, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। পরিবার বা প্রিয়জনদের সঙ্গে অবসর সময় কাটাতে পারেন। পরিবারের সান্নিধ্যে থাকতে হবে। ৭. উচ্চ রক্তচাপ যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ৮. কোলেস্টেরল এর মাত্রা অবশ্যই লিমিটের মধ্যে রাখতে হবে। ৯. সামাজিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। ১০. ডায়াবেটিস যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে সেই বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।


এছাড়াও ডিমেনশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের উপর পরামর্শ দেন। তা হলো- ৫টি ঈ এর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তা হলো (১) ঈধৎফ: প্রত্যেকটি ডিমেনশিয়া রোগী গলায় বা সঙ্গে ঈধৎফ রাখতে পরামর্শ দেন। ঈধৎফ এ তার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর উলেস্নখ থাকবে। ২. ঈধষষবহফবৎ: রুমে ক্যালেন্ডার বা বাতাসে নড়ে এমন কিছু রাখা যাবে না। তা ডিমেনশিয়া রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। রুমে পর্দা থাকলেও সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ক্যালেন্ডার বা পর্দা ফিক্সড করে আটকে রাখতে হবে। (৩) ঈযধহমব ড়ভ চষধপব/অফফৎবংং: কোনোভাবেই ডিমেনশিয়া রোগীর স্থান বা ঠিকানা পরিবর্তন করা যাবে না। অনেকেরই ধারণা থাকে ডিমেনশিয়া রোগীর আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গেলে ভালো থাকবে, ধারণাটি সঠিক নয়। এছাড়াও তাদের রুম যত্রতত্র পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। ডিমেনশিয়ার রোগী একই স্থানে থাকলে স্বস্তি বোধ করে। অন্যথায় তাদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। (৪) ঈযধহমব ড়ভ ভঁৎহরঃঁৎব: ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন এমন অবস্থায় তাদের রুমের আসবাবপত্র, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অর্থাৎ বিছানা, টেবিল, ল্যাম্প, আলনা, চিরুনি, আয়না বা কোনো কিছুই সরানো যাবে না। (৫) ঈঁৎরড়ঁং য়ঁবংঃরড়হ: আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই বয়স্ক মানুষরা শিশু সুলভ আচরণ করেন। তাদের মনে থাকে বাধভাঙ্গা প্রশ্ন। তারা মনে করেন সব কিছু নতুন করে দেখছেন। মেমরি লস থেকে এই সমস্যার সৃষ্টি হয় তাই তাদের সঙ্গে রাগ বা বিরূপ আচরণ করা যাবে না। ধৈর্য্য ধরে তাদের কথা শুনতে হবে। এছাড়াও আমি ব্যক্তিগতভাবে আরেকটি ঈ যোগ করতে চাই তা হলো: ঈধৎব মরাবৎ প্রত্যেকটি ডিমেনশিয়া রোগীর জন্য ঈধৎব মরাবৎ খুবই প্রয়োজন। অন্যথায় তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। কারণ ডিমেনশিয়া রোগীদের খাওয়া, গোসল করা, গ্যাস এর চুলা খোলা বা বন্ধ রাখা, দরজা খোলা বা বন্ধ করা, যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে, বাসা থেকে বের হয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ওষুধ খাওয়াসহ শারীরিক বা মানসিক যত্নের জন্য সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য একজন সহযোগী থাকা প্রয়োজন হোক তিনি আত্মীয় বা কেয়ার গিভার ডিমেনশিয়া রোগী পরিচর্যা করা খুব সহজ কোনো বিষয় না বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অবশ্যই ডিমেনশিয়া রোগীর পুরো কেইস টেকিং, পরিচর্যা ও খাদ্যাভাস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। আমরা বেশির ভাগ মানুষই ওষুধনির্ভর। কারণ কোনো অসুখ দেখা দিলেই শারীরিক বা মানসিক যত্ন না নিয়ে শুধু চিকিৎসার দিকে সর্বাত্মক ঝুঁকে থাকি। চিকিৎসার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক যত্ন খুবই প্রয়োজন।


ডিমেনশিয়া, অবহেলা নয় সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন || ডা. আবিদা সুলতানা 
Dementia, not neglect requires social awareness || Dr. Abida Sultana

No comments

Powered by Blogger.