মাথা ব্যথার কারণ ও প্রতিকার || Headache causes and remedies || Dr. Abida Sultana
যেসব কারণে একজন মানুষের কর্মক্ষমতা ও সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে এই ‘মাথা ব্যথা’। স্নায়ুরোগের মধ্যেও মাথা ব্যথার হার সবচেয়ে বেশি। বারবার মাথা ব্যথার কারণে ভুক্তভোগীরা পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও পেশাগত জীবনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বব্যাপী মোট বয়স্ক (১৮ থেকে ৬০ বছর) জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ প্রতিবছর মাথা ব্যথায় অন্তত একবার আক্রান্ত হয়।
এসব রোগীর মধ্যে ১১ শতাংশ মাইগ্রেন বা আধকপালি মাথা ব্যথা, ৭০ শতাংশ টেনশন টাইপ হেডেক বা মাংসপেশির সংকোচনজনিত মাথা ব্যথা এবং ৩ শতাংশ ক্রনিক ডেইলি হেডেক বা দীর্ঘস্থায়ী মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হয়। সাধারণত বয়স্ক মহিলারাই বিভিন্ন ধরনের মাথা ব্যথায় কষ্ট পায়
আরো পড়ুন পড়া কমাতে যেসব অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি
মাথা ব্যথার রকমফের
মাথা ব্যথা প্রধানত দুই প্রকার। প্রথমত প্রাইমারি হেডেক। যেমন—মাইগ্রেন, টেনশন টাইপ হেডেক, ক্লাস্টার হেডেক ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত সেকেন্ডারি হেডেক। যেমন—সাইনুসাইটিস, মাসটয়ডাইটিস, গ্লকোমা, স্ট্রোক, মাথার আঘাতজনিত ব্যথা, মস্তিষ্কের টিউমার ইত্যাদি।
প্রাইমারি হেডেক
মাইগ্রেন : ১১ শতাংশ বয়স্ক মানুষের এই ধরনের মাথা ব্যথা হয়। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে মাইগ্রেন বেশি দেখা যায়।
সাধারণত ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে মাইগ্রেনের লক্ষণ দেখা দেয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মাইগ্রেনের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ—
⬤ মাথার যেকোনো এক পাশে ব্যথা হয়। একবার এক পাশে ব্যথা হলে পরে অন্য পাশেও ব্যথা হতে পারে।
⬤ চার থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যথা স্থায়ী হতে পারে।
⬤ রক্তনালি (ধমনি/শিরা) সংকোচন/প্রসারণ বা টনটন প্রকৃতির ব্যথা অনুভূত হয়।
⬤ ব্যথা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং এ সময় কোনো কাজ করা যায় না।
⬤ আলো বা শব্দে ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যায়।
⬤ ব্যথার সঙ্গে বমিভাব বা বমি হতে পারে।
⬤ ব্যথা শুরুর আগে চোখের সামনে আলোর নাচানাচি, আঁকাবাঁকা লাইন ইত্যাদি দেখে রোগী মাইগ্রেন যে হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারে।
⬤ অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে ব্যথার তীব্রতা কমে।
টেনশন টাইপ হেডেক : ৭০ শতাংশ বয়স্ক মানুষের এই ধরনের মাথা ব্যথা হয়ে থাকে। টেনশন টাইপ হেডেকও মাইগ্রেনের মতো কৈশোরে শুরু হয় এবং মহিলাদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। মাথার মাংসপেশির সংকোচনের কারণে এই মাথা ব্যথা হয়।
টেনশন টাইপ হেডেকের লক্ষণ নিম্নরূপ—
⬤ পুরো মাথায় ব্যথা হয়।
⬤ একটা চাপের মতো ব্যথা অনুভূত হয়।
⬤ ব্যথা মাইগ্রেনের মতো ততটা তীব্র হয় না। রোগী ব্যথা নিয়ে সব ধরনের কাজ করতে পারে। কাজের সময় ব্যথা অনুভব করা যায় না, কিন্তু কাজ শেষ করলেই মাথা ব্যথা ফিরে আসে।
⬤ সাধারণত মাথা ব্যথার সঙ্গে বমিভাব বা বমি হয় না।
⬤ এই মাথা ব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
⬤ দুশ্চিন্তা, পারিবারিক বা পেশাগত বা মানসিক চাপের সঙ্গে এই মাথা ব্যথার সম্পর্ক আছে।
ক্লাস্টার হেডেক : তুলনামূলকভাবে ক্লাস্টার হেডেক অনেক কম দেখা যায়। ০.১ শতাংশ মানুষের এই ধরনের মাথা ব্যথা হয়। পুরুষ মানুষের মধ্যে এই ধরনের মাথা ব্যথার প্রকোপ বেশি। আনুমানিক হার পুরুষঃমহিলা=৬ঃ১। সাধারণত ২০ বছর বয়সের পরে ক্লাস্টার হেডেক দেখা যায়।
ক্লাস্টার হেডেকের লক্ষণ নিম্নরূপ —
⬤ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু বারবার হয়।
⬤ অত্যন্ত তীব্র ব্যথা হয়।
⬤ চোখের চারপাশে বা পেছনে ব্যথা হয়।
⬤ চোখ লাল হয়ে যায় এবং পানি পড়ে। চোখের ওপরের পাতা পড়ে যেতে পারে।
⬤ প্রতিদিন একই সময়ে বা দিনে কয়েকবার ব্যথা হয় এবং কয়েক সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হয়। এরপর ব্যথা চলে যায় এবং কয়েক মাস বা বছর পর আবার একইভাবে ব্যথা শুরু হয়।
সেকেন্ডারি হেডেক
শারীরিক বা মাথার বিভিন্ন রোগের কারণে মাথা ব্যথা হতে পারে। এসব মাথা ব্যথাকে সেকেন্ডারি হেডেক বলে। যেমন—মস্তিষ্কের আবরণী প্রদাহ (ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়ার বা টিউমারফুলার
মেনিনজাইটিস), সাইনুসাইটিস, মাসটয়েডাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমার, রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক, মাথায় আঘাতজনিত কারণ ইত্যাদি।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
মাথা ব্যথার বেশির ভাগ রোগীই জীবনে কখনো মাথা ব্যথার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না, নিজেরাই ব্যথানাশক বিভিন্ন ওষুধ খায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, খোদ যুক্তরাজ্যে ও যুক্তরাষ্ট্রে গত এক বছরে মাত্র ৫০ শতাংশ মাইগ্রেনের রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছে।
দেখা গেছে, সেকেন্ডারি হেডেকের রোগীদের যখন বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা যায় যেমন— অতিরিক্ত বমি, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, হাত বা পায়ে বা মুখে অবশ বা খিঁচুনি হয়, শুধু তখনই চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য হাসপাতালে বা চেম্বারে যায়।
এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতির ফলে অতি সহজে মাথাব্যথার রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। সিটি স্ক্যান, এমআরআই বা পিইটি স্ক্যানের মাধ্যমে মাথার বিভিন্ন অংশের সুস্পষ্ট ইমেজ বা ছবি পাওয়া যাওয়ার কারণে মাথা ব্যথার কারণ উদঘাটন সম্ভব হয়েছে।
মাথা ব্যথার ধরন বা কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন রোগ নির্ণয় করা। প্রাইমারি হেডেকের চিকিৎসা দুই স্তরে করতে হয়।
মাথা ব্যথা তাৎক্ষণিক নিরাময় করা : ব্যথা দ্রুত নিরাময়ের জন্য বিভিন্ন বেদনানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এসব বেদনানাশক ওষুধের সঙ্গে অবশ্যই পেপটিক আলসার নিরোধী ওষুধ খেতে হবে। অতিরিক্ত বেদনানাশক ওষুধ সেবনেও মাথা ব্যথা হতে পারে। তাই অতীব প্রয়োজন ছাড়া বেদনানাশক ওষুধ সেবন করা উচিত নয়।
প্রফাইলেকটিক চিকিৎসা : বারবার মাথা ব্যথা যেন না হয় এবং ব্যথার তীব্রতা যেন কম থাকে সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি যেসব ওষুধ সেবন করতে হয় তাই প্রফাইলেকটিক চিকিৎসা। যেমন—অ্যামিট্রিপটাইলিন, নরট্রিপটাইলিন, প্রপানলল, সোডিয়াম ভ্যালপ্রোয়েট, টোপিরামেট ইত্যাদি ওষুধ। ওষুধের পাশাপাশি কিছু অভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে। অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান, চা-কফি পান, অনিয়মিত এবং অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন, রোদ বা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া, অতিরিক্ত শারীরিক, মানসিক পরিশ্রম, ক্ষুধার্ত থাকলে, যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ইত্যাদি মাথা ব্যথার কারণ। তাই এসব অভ্যাস বা অসুবিধা পরিবর্তন বা সমাধান করলে মাথা ব্যথা অনেকাংশে কমে আসবে।
সেকেন্ডারি হেডেক : সেকেন্ডারি হেডেকের চিকিৎসার জন্য সাধারণত যে কারণে মাথা ব্যথা হচ্ছে সে কারণের চিকিৎসা করতে হবে। একজন নিউরোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করলেই রোগ নিরাময় সম্ভব।
No comments