সুস্থ থাকতে গর্ভধারণকারী মাকে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে || There are certain things that expectant mothers should follow to stay healthy || Dr. Abida Sultana
গর্ভধারণ যে কোনো নারীর জীবনে পরম আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। এ সময়ে তারা গুরুজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীর উপদেশ মানতে গিয়ে বুঝতে পারেন না কোনটি তাদের করা উচিত। এসব উপদেশ অনেক সময় মা ও বাচ্চার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য কনসিভের পরপরই একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থেকে প্রেগনেন্সি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কোনো রিস্ক ফ্যাক্টর (যা মা অথবা বাচ্চার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ) আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
গর্ভধারণের পর প্রথম যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা
ঘটতে পারে তা হলো গর্ভপাত। এজন্য পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় বিভিন্ন কুসংস্কারকে
দায়ী করেন, যেমন
সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়া, স্বামী-স্ত্রীর সহবাস, সামান্য আঘাত পাওয়া ইত্যাদি। সাধারণভাবে এগুলো গর্ভপাতের জন্য দায়ী না। প্রতি একশ
জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে ১৫
জনের ক্ষেত্রে প্রথমবার গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে। ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে এর কারণ নির্ণয় করা যেতে পারে।
গর্ভবতী মায়ের জন্য দরকার সুষম খাদ্যতালিকা, এতে করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত ও
খাদ্যঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। এ সময় প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে মাংস, ডিম, মাছ ও দুধ। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি
শাক-সবজি ও ফল খেতে হবে। কেনা ফলমূল, শাক-সবজি বাজার থেকে আনার পর আধাঘণ্টা পর্যন্ত পানিতে
ভিজিয়ে খেলে ফরমালিনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এ সময় প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান
করতে হবে। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।
পেঁপে ও আনারস পেটের জন্য উপকারী ফল এবং
পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যায়। তবে যাদের গর্ভপাতের হিস্ট্রি আছে তাদের প্রথম তিন মাস
অতিরিক্ত কাঁচা পেঁপে ও আনারস না খাওয়াই ভালো। কারণ কিছু ক্ষেত্রে এগুলো জরায়ুর
সংকোচন ঘটিয়ে গর্ভপাত করতে পারে।
এ সময়ে আধাসিদ্ধ মাংস, আনপাস্তুরাইজড মিল্ক, হট ডগ খেলেও লিস্টেরিয়া নামক জীবাণুর সংক্রমণ
থেকে গর্ভপাত হতে পারে। বাড়ির পোষা বিড়াল থেকেও অনেক সময় এই জীবাণু সংক্রমিত হতে
পারে।
পরিমিত হালকা ধরনের কাজ
নারীর গর্ভকালীন সময়ে প্রথম দু-তিন মাস ও
শেষের তিন মাস
অতিরিক্ত পরিশ্রম না করে হালকা হাঁটাচলা করা উচিত। ভারী জিনিস বহন করা বা তোলা
যাবে না। পিচ্ছিল স্থানে হাঁটা যাবে না এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বিশেষ সতর্কতা
অবলম্বন করতে হবে।
অনেক মা এ সময় শারীরিক পরিশ্রম ও সহবাস করা
থেকে বিরত থাকেন। প্রকৃতপক্ষে কিছু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা (যেমন, প্লাসেন্টা প্রিভিয়া, রিপিটেড এবরসন) ছাড়া গর্ভবতী মায়েরা স্বাভাবিক সব
কাজই চালিয়ে যেতে পারেন। তবে প্রথম ও শেষ তিন মাস কিছুটা সাবধানে থাকতে বলা হয়।
ঘুম
এ সময় দিনের বেলা কমপক্ষে দু-ঘণ্টা ঘুম বা
বিশ্রাম এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। ঘুমানো বা বিশ্রামের সময় বাঁ-কাত
হয়ে শোয়া ভালো।
যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তাদের অতিরিক্ত চা, কফি বাদ দিতে হবে এবং প্রি-এক্লাম্পসিয়া বা প্রেসারের
সমস্যা থাকলে খাবারে অতিরিক্ত
লবণ খাওয়া উচিত হবে না।
পরিধেয়
গর্ভবতী মায়েদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিত।
সঠিক মাপের এবং নরম জুতো পরতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই হিল পরিহার করা উচিত।
অনেক মা তাদের পেটিকোট বা সালোয়ারের বাঁধন
পেটের উপর শক্ত করে বেঁধে রাখেন যাতে বাচ্চা উপর দিকে উঠে না যায়। প্রকৃতপক্ষে
গর্ভের বাচ্চাকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য এর চারপাশে এমনিওটিক ফ্লুইড বা পানির আবরণ থাকে এবং এই সময়ে
চিকিৎসকেরা মায়েদেরকে ঢিলেঢালা পোশাক পরার উপদেশ দেন।
ভ্রমণ
গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস ও শেষ তিন মাস দীর্ঘ
ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। উঁচু-নিচু পথ কিংবা ঝাঁকির আশঙ্কা আছে এমন যানবাহনে ভ্রমণ
করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সকালে ও বিকেলে কিছু সময়ের জন্য স্বাস্থ্যকর ও
মনোরম পরিবেশে ভ্রমণ গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভালো, এতে শরীর সুস্থ ও মন প্রফুল্ল থাকে। তাই
ফুলের বাগান, লেকের পাড়, পার্ক - এসব স্থানে ভ্রমণ করা উচিত।
শারীরিক পরিশ্রম
গর্ভবতী অবস্থায় একজন মা প্রতিদিন ৩০ মিনিট
যে কোনো মধ্যম মানের ব্যায়াম (যেমন হাঁটা, সাঁতার কাটা) করতে পারেন সপ্তাহে ৩ থেকে ৭ দিন। এতে করে অতিরিক্ত ওজন হওয়া, ডায়াবেটিস এবং প্রেসারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
আবার অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের জন্য কম ওজনের শিশু জন্ম নিতে পারে।
শরীরের বিশেষ যত্ন ও রোগ-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ
এ সময় নিয়মিত প্রতিদিন সাবান দিয়ে ভালোভাবে
গোসল করতে হবে এবং হাত-পায়ের নখ কেটে ছোট রাখতে হবে। গর্ভকালে মায়েদের দাঁতগুলো
বেশ নরম হয়ে যায়, তাই দাঁত ও
মাড়ির বিশেষ যত্ন নিতে হবে। চার থেকে আট মাসের মধ্যে অবশ্যই টিটেনাসের টিকা দিতে
হবে। এ সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। তাই হাম,
ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকেন পক্স
ইত্যাদি ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত রোগী থেকে দূরে থাকতে হবে।
অনেক মা মনে করেন ভিটামিন ওষুধ খেলে বাচ্চা
বড় হয়ে যায় এবং সিজারের সম্ভাবনা বাড়ে। এটি একটি ভুল ধারণা। ভিটামিন মায়ের শরীরের
রক্তশূন্যতা দূর করে এবং হাড় ক্ষয়ের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
বিশেষ সতর্কতা
অতিরিক্ত আবেগ, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, ভয়, রোগ-শোক ইত্যাদি গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, তাই এসব এড়িয়ে ভালো চিন্তা করতে হবে। প্রথম
তিন মাস ও শেষ তিন মাস স্বামীর সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া
ওষুধ সেবন করা যাবে না। পানিশূন্যতা রোধে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক পরিমাণে পানি পান
করতে হবে।
অনেক মায়ের সংশয় থাকে অতিরিক্ত আলট্রাসাউন্ড
বাচ্চার কোনো ক্ষতি করে কিনা। আলট্রাসাউন্ডে যে পরিমাণ রেডিয়েশন থাকে তা বাচ্চার
জন্য ক্ষতিকর নয়। সাধারণত প্রেগনেন্সিতে দুই-চারবার আলট্রাসাউন্ড করা লাগতে পারে।
তবে মা বা বাচ্চার কোনো কোনো জটিলতার ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি এই পরীক্ষা করার
দরকার হতে পারে।
সবশেষে মনে রাখা উচিত, গর্ভবতী মাকে সব সময় হাসিখুশি ও
দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। কারণ গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক অবস্থা পরবর্তীকালে
শিশুর বিকাশে প্রভাব ফেলে, যা গবেষণায় প্রমাণিত। তাই এ সময়টাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করতে হবে।
সুস্থ থাকতে গর্ভধারণকারী মাকে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে || ডা. আবিদা সুলতানা
There are certain things that expectant mothers should follow to stay healthy || Dr. Abida Sultana
আর্টিকেলটি ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
আরো পড়ুন ধূমপান ছাড়ার কিছু কার্যকর খাবার
No comments