স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে উৎসবে মিষ্টি খাওয়া কমাতে হবে || In order to reduce health risks, sweets should be reduced during the festival || Dr. Abida Sultana
মিষ্টি বাংলাদেশের মানুষের অত্যন্ত প্রিয়। তাই যে কোন উৎসবেই চাই মিষ্টি। কিন্তু মিষ্টি আমাদের কতটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে?
শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত বা পাকিস্তানেও আকর্ষণীয় একটি খাদ্য উপাদান মিষ্টি। এই দেশগুলো যত সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় সব জায়গায় মিষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিষ্টি ছাড়া এসব জায়গায় কোন অনুষ্ঠানই হয় না। তবে আমরা যদি পুষ্টির বিষয়টা বিবেচনায় আনি, তাহলে মিষ্টি খারাপের দিকটাই বেশি। ভালো দিকটা কম। মিষ্টি অতি দ্রুত খাদ্যে গ্লুকোজ সরবরাহ করে। আর আমাদের শরীরে যে জ্বালানি সরবরাহ হয়, সেটা মূলত গ্লুকোজ থেকে আসে। অনেকেই দিনে ৩-৪ বার খাবার খান। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের দিনে ৬ বারও খেতে বলে আমরা। কম বয়সিরাও বেশি বার খায়। তবে এই অর্থ এই নয় যে, বেশি মিষ্টি খেয়ে রক্তে গ্লুকোজে তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানুষ ওজন বেড়ে যাচ্ছে। এর পিছনে কিন্তু মিষ্টি জাতীয় খাবারের একটা হাত আছে। এছাড়া অন্যান্য খাবারেও আছে। অনেকে প্রশ্ন করেন, মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয় কি-না? এর সরাসরি উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। তবে যাদের ডায়াবেটিস হয়নি, তাদের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মিষ্টি জাতীয় খাবার কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের মিষ্টি জাতীয় খাবার যতটা কমিয়ে আনা যায়, ততটাই ভালো। অর্থাৎ আমাদের উল্টোটা করতে হবে। যে খাবারগুলো খেলে রক্তে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ সরবরাহ হবে, যে খাবারগুলো খেলে রক্তে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ সরবরাহ হবে, সেই খাবারগুলো বেশি বেশি খেতে হবে। ডায়াবেটিসের কারণে আমাদের হৃদরোগ সহ অন্যান্য রোগ বেড়ে যাচ্ছে।
'মিষ্টিতে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ থাকার কথা নয়' শরীরে নিশ্চয়ই মিষ্টির প্রয়োজনীয়তাও আছে?
অবশ্যই আছে। যাদের আর্থিক সংগতি নেই বা কম খাবার পান, তাঁরা যদি এখনই একটা মিষ্টি খেয়ে নেন, তাহলে দেখবেন রক্তের দ্রুত গ্লুকোজ সরবরাহ হয়ে যাচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এতে করে পরবর্তী খাবারের সময়টা কিন্তু এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ অন্য সময় তিনি যতটা দেরিতে খাবার খেতেন, মিষ্টি খেলে তাঁকে পরবর্তী খাবার আগেই খেয়ে নিতে হবে। মিষ্টিতে যে গ্লুকোজ আছে সেটা অন্যান্য খাবারেরও কিন্তু আছে। ভাত, আলু বা সব ধরনের শর্করা জাতীয় খাবারে গ্লুকোজ আছে। তবে এগুলো আস্তে আস্তে রক্তের গ্লুকোজ সরবরাহ করে। মিষ্টি কথা আলাদাভাবে বলার কারণ হলো এর গ্লুকোজ অতি দ্রুত রক্ত চলে যায়। অন্যগুলো একটু সময় নেয়।
মিষ্টি কি উপাদান দিয়ে তৈরি হয়?
আমাদের দেশের মান সম্পন্ন মিষ্টি হলে সেটা দুধ থেকে তৈরি হওয়ার কথা। এখন দেশে অনেকেই মিষ্টিটা অনেক বেশি চিনি দিচ্ছেন, গুড় দিচ্ছেন। অন্য দিকে দেশে ডায়াবেটিস মিষ্টিও তৈরি হচ্ছে। এই ডায়াবেটিস মিষ্টিতে ক্যালরি কারক দ্রব্য কম দিলে মিষ্টি বেশি লাগার কথা। তবে এগুলো বেশি ব্যবহার করলে মিষ্টি তিতা হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ মিষ্টির দোকানিরা যে ডায়াবেটিস মিষ্টি তৈরি করছেন, সেগুলা কিন্তু তিতা লাগছে না বরং মিষ্টিই লাগছে!
মিষ্টিতে ক্ষতিকর কোন পদার্থটা বেশি থাকে?
মিষ্টিতে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ থাকার কথা নয়। দেখুন দোকানের মিষ্টি দীর্ঘ সময় থাকে। অথচ তারপরও নষ্ট হয় না। এখন মিষ্টিতে যদি অন্য কিছু না মিশিয়ে শুধু দুধ বা ছানা দিয়ে তৈরি করা হয়, তাহলে তো সেটা দীর্ঘ সময় থাকার কথা না। এর কারণ এখানেক বহুল আলোচিত ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আসছে।
বিশ্বে কি এমন কোন দেশ আছে, যেখানে শতভাগ স্বাস্থ্যকর মিষ্টি তৈরি হয়?
এটা সম্ভব নয়। যেখানে সবাই স্বাস্থ্য সচেতন, সেখানে মিষ্টি খাওয়ার প্রবণতা অনেক কম। যেমন ধরুন, কানাডা। সেখানে প্রতিটি দোকানে প্রতিটি খাবারের প্রতিটি উপাদান সরকার থেকে বেঁধে দেওয়া। এছাড়া অন্যান্য কিছু দেশও মিষ্টি তৈরি কমিয়ে আনছে।
বাংলাদেশের মিষ্টি পোড়াবাড়ির চমচম
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় মিষ্টির রাজা। যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরীর তীরের গ্রাম পোড়াবাড়িতে প্রথম এই মিষ্টি তৈরি শুরু হয়। এখানকার নদীর পানি নাকি সেই মিষ্টির স্বাদে আলাদা একটি বিশেষত্ব যোগ করত। প্রায় দেড়শ বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার অনেক জন লোক রাজা রাম গোবরার হাতে জন্ম হয় সুস্বাদু এই চমচমের।
মিষ্টির এত ক্ষতিকর দিকের পরও মিষ্টির সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারছি না কেন?
আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। তখন তো অত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছিল না। তাছাড়া সংস্কৃতি চাইলেও আপনি বদলে ফেলতে পারবেন না। এখন আমি যদি বলি, কোন অনুষ্ঠান হলে সেখানে মিষ্টি বর্জন করে অনুষ্ঠান করতে হবে, তাহলে কি আপনি সেটা মানবেন? একটা বাচ্চা স্কুলে ভালো রেজাল্ট করেছে বা পরিবারের কোনো ভালো খবর এসেছে, আমাদের দেশে সেটা প্রকাশের ভাষা হল যার যে সামর্থ্য আছে সেই অনুযায়ী মিষ্টি বিতরণ করা। কোন আনন্দের উপলক্ষ্য হলেই সেখানে মিষ্টি থাকবে। আমাদের দেশের জন্য এটা থেকে বের হয়ে আসাটা খুবই জরুরী।
মিষ্টির দোকানের মালিকটা কি কখনো ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন?
কখনোই না। কারন আমাদের দেশে প্রতিটা দোকানে যে খাদ্য উপাদান রাখা হয়, সেটা স্বাস্থ্যসম্মত কি-না সেটা দেখার দায়িত্ব বিএসটিআই -এর। তারা কি সেটা করছে? আমি বলবো আমাদের জনগণকে মিষ্টি নির্ভর না হয়ে আমিষ নির্ভর বা শাকসবজি নির্ভর করতে। তাহলে আপনি সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।
বাংলাদেশের কোন বয়সী মানুষ সবচেয়ে বেশি মিষ্টি খায়? কোনো গবেষণা আছে কি?
মধ্যবয়সী মানুষ সবচেয়ে বেশি মিষ্টি খান। আমাদের দেশে যে পরিমাণ রোগীর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, তার অর্ধেক মানুষের এখনো ডায়াবেটিস ধরা পড়েনি। যাদের ধরা পড়েনি তাঁদের রক্তে যখন গ্লুকোজ জমে যাবে তখন তার ভেতর থেকেই মিষ্টি খাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হবে। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি খাওয়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে তাঁর। যেটা এর আগে কিন্তু কখনোই ছিল না। এই পরিস্থিতিতে উনি যদি রক্ত পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখবেন উনার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। এমন মানুষ ৪০ লাখের কম না। এছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিতে হবে। কারণ আপনি যত অনুষ্ঠানে যাবেন তত বেশি মিষ্টি খাওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে এবং এতে আপনারই ক্ষতি। আমরা যদি 'টোটাল কনজামশন' ধরি, তাহলে মধ্যবয়সী বা ২৫ থেকে ৫০ বছরের মানুষের মিষ্টির প্রতি আগ্রহ বেশি এবং তারাই বেশি মিষ্টি খান।
মিষ্টি নিয়ে আপনার কি কোন পরামর্শ আছে?
বাংলাদেশের বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দেশ, যেখানকার অনেক মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া বাংলাদেশ অতিরিক্ত দৈহিক ওজনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং হৃদরোগেদ ঝুঁকি ও এখনো বেশি। সেক্ষেত্রে যাদের ডায়াবেটিস নেই তাঁরা তো মিষ্টি খেতে পারবেনই, আর যাদের ডায়াবেটিস আছে তাঁরাও মিষ্টি খেতে পারবেন। তবে কতটা খাবেন, এর ক্ষতি কি এগুলো জানতে হবে। এছাড়া আমাদের উৎসবের জন্য মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করতে হবে। আপনি কষ্ট করে উপার্জন করবেন এবং সেই উপার্জনের টাকা দিয়ে আপনি এমন কিছু খাবেন না যেটা আপনাকেই উল্টো স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিবে। অর্থাৎ, ডায়াবেটিসে থাকুক আর না থাকুক, সকলকেই মিষ্টি খাওয়া সীমিত রাখতে হবে।
আর্টিকেলটি ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
No comments