Header Ads

তামাক ও যক্ষ্মা || Tobacco and Tuberculosis || Dr. Abida Sultana

 

তামাক ও যক্ষ্মা || ডাঃ আবিদা সুলতানা

তামাক গাছ পাতাসমৃদ্ধ একটি ছোট উদ্ভিদ যা বিশ্বে প্রায় সবখানে জন্মায়। এই গাছ আকারে ছোট হলেও এর ব্যবহার মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তথ্যানুযায়ী ষোড়শ শতাব্দীতে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপে তামাকের প্রচলন ঘটে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ বিভিন্নভাবে তামাক ব্যবহার করে আসছে। সিগারেট, পাইপ, সিগার, বিড়ি, হুক্কা ছাড়াও জর্দা, সাদা পাতা, গুল খৈনি ইত্যাদি আকারে মানুষ তামাক ব্যবহার করে।

সাধারণত পিতা-মাতার তামাক সেবনের অভ্যাস, কৌতূহল, সঙ্গী-সাথীদের চাপ, আমি এখন সবকিছু করার উপযুক্ত এবং স্বাধীন এমন মনোভাব থেকে তামাক সেবনের সূত্রপাত ঘটে। তামাক সেবন নিয়মিত অভ্যাসে পরিনত হওয়ার পর তামাকের মধ্যে নিহত নিকোটিন নামক এক ধরনের পদার্থ এই অভ্যাস পাকাপাকিভাবে চালিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং পরিণতিতে এটা জীবনাচারের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সিগারেট সেবন সম্পর্কে বিখ্যাত দার্শনিক রাসেল বলেছেন, "জানা মতে তামাক সেবন সব থেকে নেশা উৎপাদনকারী এবং নির্ভরতা আআত্মতৃপ্তির অন্যতম উপায়।" লন্ডনের মাদক ব্যবহারকারীদের রেটিং অনুযায়ী, হেরোইন, গাঁজা, এলএসডি মদের তুলনায় সিগারেটই তাদের কাছে নেশার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রয়োজনীয় উপাদান।

তামাক সেবন এতটাই ক্ষতিকর যে, তামাকসেবীদের অর্ধেকেই এই নেশায় কারণে মৃত্যুবরণ করে। চলতি হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে তামাকসেবীদের  সংখ্যা ১১০ কোটির উপরে। ১৯৫৫ সালে উন্নত বিশ্বে তামাক সেবনের ফলে ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা যেত। তখন অনুন্নত বিশ্বে তামাক সেবন জনিত মৃত্যু সংখ্যা ছিল এর অর্ধেক অর্থাৎ ১০ লাখ। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নত বিশ্বে তামাক সেবনজনিত মৃত্যুর হার কমতে থাকে এবং অনুন্নত বিশ্বে মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে।

হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ তামাক সেবনের সাথে সম্পৃক্ত। জনসংখ্যার বাকি অংশ তামাক সেবনের পরোক্ষ ঝুঁকির মধ্যে এসে বসবাস করছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৭ হাজার মানুষ তামাক সেবন জনিত বিভিন্ন রোগে মারা যায়। এছাড়া তামাক সেবনের পরোক্ষ কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তামাক সেবনের পিছনে এদেশের মানুষ প্রতিদিন ব্যয় করে প্রায় কোটি টাকা। বছরে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায়। তামাক সেবনের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত চিকিৎসায় বছরে ব্যয় হয় ১১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া তামাক চাষের ফলে ব্যাপক পরিমাণ ধান উৎপাদন হ্রাস পায় বলে খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি থেকে যায়।

তামাক সেবন, তা যেভাবেই হোক না কেন, বিশ্বব্যাপী জনসাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক সেবনের ফলে মানব দেহে যেসব অসুখ হয় ফুসফুসের ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম। অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। অধূমপায়ীদের তুলনায় ফুসফাসে ক্যান্সারে ধূমপায়ীদেরদের মৃত্যুর সংখ্যা থেকে ২৫ গুন বেশি। এটা নির্ভর করে সিগারেট খাওয়ার পরিমাণের উপর। পাইপ সিগার স্মোকারদের ফুসফুসের ক্যান্সারের মৃত্যু ঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় অনেক বেশি হলেও সিগারেট স্মোকারদের চেয়ে কম। অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগে ক্যান্সার বিশেষ করে বাগযন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি ৫০ গুণ বেশি। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস এবং এমফায়সীমা (ফুসফুসের কুঠুরীসমূহে বাতাস আটকে থাকা) নামক অসুখে খাওয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দৈনিক ২৫ শলাকা বা তার বেশি সিগারেট খায় এমন লোকেদের ফুসফুস ক্যান্সার হওয়া ঝুঁকি অনেক বেশি।

এদের মৃত্যুর হার অধূমপায়ীদের তুলনায় বুশ গুণ বেশি। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের জন্য বায়ু দূষণ যতটা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী ধূমপান। ধূমপানের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমুনারি ডিজিজ (সিওপিডি) হতে পারে। এটা নির্ভর করে সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ সময়ের উপর। সিওপিডি একটি মরণব্যাধি হলেও আগে ভাগে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করলে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।

স্কিমিক হার্ট ডিজিজ (হৃদযন্ত্রের অপরিমিত রক্ত চলাচল জনিত হৃদরোগ), সেরিব্রোভাস্কুলার ডিজিজ (মস্তিষ্কের শিরাজনিত অসুখ) এবং পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজে মৃত্যু এবং ভোগান্তির কারণ হিসেবে সিগারেট খাওয়ার গুরুত্ব কত বেশি তা বর্ণনা করা না হলে বিষয়টির প্রতি অবিচার করা হবে।

সিগারেট খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে স্ট্রোক হতে পারে।স্ট্রোকে কারো কারো মৃত্যু হয়। কেউ কেউ পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজড) হয়ে বেঁচে থাকে আবার কেউ কেউ কোমায় চলে যায়। সিগারেট খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজে (শরীরের প্রান্তিক শিরাজনিত অসুখ) আক্রান্তদের শতকরা ৯০ ভাগই সিগারেট স্মোকার।ঠিকমতো চিকিৎসা না করলে অনেক সময় এদের পায়ে পচন ধরে এবং পা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। তবে পা কেটে ফেলার ক্ষেত্রে সফলতার হারও খুব কম। অনেক সময় শিরা শক্ত হয়ে ভেঙ্গে গিয়ে রক্তপাত হতে থাকে।

সিগারেট খাওয়ার ফলে অন্ত্রের যে কোনো অংশে (ঠোঁট থেকে গুহ্যদ্বার পর্যন্ত) ক্যান্সার হতে পারে। ধূমপায়ীদের মুখগহ্বরে ক্যান্সার হওয়া কোনক অস্বাভাবিক বিষয় নয়। ইসোফেজিয়াল ক্যান্সারের (খাদ্যনালীর ক্যান্সার) সাথে সিগারেট খাওয়ার গভীর সম্পর্ক আছে. খাদ্যনালির ক্যান্সারে অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের মৃত্যুর হাফ আট গুণ বেশি। তবে এটা সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। ধূমপায়ীদের অগ্নাশয়ে (প্যাংক্রিয়াস) ক্যান্সার হওয়ারও বিচিত্র কিছু নয়। তবে পাকস্থলীর ক্যান্সারের মতো এটা তত ভয়াবহ নয়। এছাড়া ধূমপায়ীদের মলাশয় (ব্রহদান্ত্র) গুহ্যদ্বারে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। ধূমপান পেপটিক আলসারেরও অন্যতম কারণ। ধূমপানের ফলে পেপটিক আলসার সারতে অনেক দেরি হয়। কখনো কখনো পাকস্থলি ছিদ্র হয়ে যেতে যেতে পারে।

ডাঃ আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্য পরামর্শ বিষয়ক বই আসুন সুস্থ থাকি https://www.rokomari.com/book/280680/asun-sustho-thaki

ডাঃ আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্য পরামর্শ বিষয়ক বই আসুন সুস্থ থাকি


ধূমপানের ফলে মূত্রাশয়ে ক্যান্সার হতে পারে এবং যৌন আবেদন হ্রাস পায়। নর- নারীর সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। মহিলা ধূমপায়ীদের গর্ভাশয়ে ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অনেকের অকালে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপানের কারণে চোখের জ্যোতি কমে যেতে পারে এবং চোখে ছানি পড়তে পারে। এছাড়া হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস পায় এবং শরীরে অকাল বার্ধক্যের ছাল পড়তে পারে।

যক্ষ্মার সাথে তামাক সেবনের সরাসরি কোন যোগসূত্র নেই। কারণ, যক্ষা বায়ুবাহিত একটি জীবণুঘটিত রোগ। মানবদেহে যক্ষ্মা হতে হলে চারটি পূর্ব শর্ত দরকার। এগুলো হলো:- শরীরে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা, অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতা, শরীরে অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যক্ষ্মাজীবাণুর শক্তি বা তীব্রতা এবং যক্ষ্মাজীবাণুর সংখ্যা। এই চারটি কারণের ভারসাম্যের উপর মানবদেহে যক্ষ্মা হওয়া না হওয়া নির্ভর করে। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের শ্বেতকণিকা এবং শ্বেতকণিকার সমন্বয়ে গঠিত ম্যাক্রোফেজ নাম সেল থেকে এক ধরনের রসের (এ্যানজাইম) নিঃসরণ ঘটে। সাধারণভাবে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ করলে ফুসফুসের কুঠুরি গুলো স্বাভাবিকভাবে স্ফিত হয় কিন্তু সংকুচিত হয় না। এটাকে এম্ফায়সিমা বলে। অন্যদিকে সিগারেট খাওয়ার কারণে সিগারেট ধোঁয়ায় নিহিত নাইট্রোজেন অক্সাইড ফুসফুসের কুঠুরে গুলোর সংকোচন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া সিগারেটের ধোঁয়াউ নিহিত অক্সিডেন্টস নামক এক ধরনের উপাদান শরীরের অভ্যন্তরে নিঃসরিত এন্টিট্রিস্পিন নামক রস কমিয়ে দেয়। এই রস শ্বাসনালীর সংক্রমণ শিরার সংকোচন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধূমপানের কারণে ফুসফুসের নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে যক্ষ্মা সহ শ্বাসতন্ত্রের ক্রনিক সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

ধূমপানজনিত কারণে সারা বিশ্বের প্রতিবছর ৩০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ২০২০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা কোটিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এশিয়া পূর্ব ইউরোপে ধূমপায়ীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা বিশ্বে মানুষ যত সিগারেট খায় তার অর্ধেকই খায় ইউরোপের লোকেরা। সচেতনতার কারণে উন্নত বিশ্বে ধূমপায়ীদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো টার্গেট এখন উন্নয়নশীল বিশ্ব। ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্য চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি, জনশক্তির উৎপাদনশীলতা হ্রাস, খাদ্য উৎপাদনে ভূমির অপচয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে সিগারেট আমদানির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের চিকিৎসক চিকিৎসা পেশায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়িত্ব এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। তারা ধূমপানের ক্ষতি করে তুলে ধরার মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বের জনগণের উপর এর কুপ্রভাব সম্পর্কে জনমত সৃষ্টি করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সে দেশের সরকার গুলোকে সতর্ক করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং শক্তিধর আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত, ব্যাপারে কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশসমূহে ধূমপানজনিত সমস্যাগুলো তুলে ধরা। উন্নয়নশীল দেশে প্রত্যেকটি সরকারে তাদের ধূমপান বিরোধী নীতি নির্ধারণের উৎসাহ দেওয়া তাদের দায়িত্বের অন্তর্গত। এছাড়া তামাক সেবন নিরুৎসাহিত করার জন্য তামাক সামগ্রীর উপর বেশি বেশি করারোপের জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বের সরকার গুলোকে চাপ দেয়া, তামাক বিরোধী আন্দোলনে উৎসাহ প্রদান এবং শিশু কিশোরদের তামাক সেবনে নিরুৎসাহিত করা সংক্রান্ত কর্মসূচি নেয়া উচিত।

বাংলাদেশে তামাক উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ ধূমপান বিরোধী কিছু কিছু কর্মসূচি গৃহীত হওয়ার কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা প্রায় অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে আরো কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তামাক বিরোধী জনসচেতনতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।


আরো পড়ুন   যক্ষ্মার ঝুঁকি কাদের বেশি


তামাক ও যক্ষ্মা || ডাঃ আবিদা সুলতানা || Tobacco and Tuberculosis || Dr. Abida Sultana

No comments

Powered by Blogger.