ব্রঙ্কিএকটেসিস || Bronchiectasis || Dr. Abida Sultana
গ্রিক ব্রঙ্কোস এবং একটেসিস শব্দ থেকে ব্রঙ্কিএকটেসিস শব্দের উৎপত্তি। গ্রীক ভাষায় ব্রঙ্কোস শব্দের অর্থ উইন্ডপাইপ বাংলায় শ্বাসনালী এবং একটেসিস শব্দের অর্থ এক্সটেনশন, বাংলায় সম্প্রসারণ। আরো সহজ করে বললে বলা যায়, শ্বাসনালীর অংশবিশেষের স্থায়ী সম্প্রসারণের ফলে সৃষ্ট শারীরিক বিপত্তির নাম ব্রঙ্কিএকটেসিস। স্টেথিসকোপ আবিষ্কারক রেন লেনেক ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ব্রঙ্কিএকটেসিস রোগ শনাক্ত করেন। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে স্যার উইলিয়াম অসলার ব্রঙ্কিএকটেসিস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। ধারণা করা হয়, অসলার নিজেও অনির্ণিত ব্রঙ্কিএকটেসিসে মারা যান। যুক্তরাজ্যে প্রতি এক হাজার অধিবাসীর মধ্যে একজন ব্রঙ্কিএকটেসিস রোগী দেখা যায়।
লক্ষণ: ব্রঙ্কিএকটেসিস শ্বাসনালীর অংশ বিশেষের স্থায়ী স্ফীত ঘটে। কফযুক্ত দীর্ঘস্থায়ী কাশি, ঘন ঘন শ্বাসপ্রশ্বাস, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া এবং বুকে ব্যথা ব্রঙ্কিএকটেসিসের বিশেষ লক্ষণ বলে ধরা হয়। এছাড়া বুকে শোঁ শোঁ শব্দ ও হতে পারে এবং নখ বেঁকে যেতে পারে। আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসে ঘন ঘন সংক্রমণ ঘটতে পারে। ব্রঙ্কিএকটেসিসে আক্রান্ত কোনো কোনো রোগীর কফ সবুজ ও হলুদ রঙের হতে পারে। প্রতিদিন কফ এর পরিমাণ পরিমাণ প্রায় ৮ আউন্স। কখনো কখনো কাশির সঙ্গে কফের বদলে রক্ত ও বের হতে পারে। এটা শুষ্ক ব্রঙ্কিএকটেসিস বলে। ব্রঙ্কিএকটেসিসে আক্রান্ত কোনো কোনো রোগীর নিঃশ্বাস থেকে দুর্গন্ধ বের হতে দেখা যায়। এতে রোগীর ফুসফুসে সংক্রমণ আছে এমনটাই নির্দেশ করে। শ্বাসনালীর ঘনঘন সংক্রমণ এবং শ্বাসকষ্ট ব্রঙ্কিএকটেসিসের সম্ভাব্য লক্ষণ।
ব্রঙ্কিএকটেসিসের কারণ: নিউমোনিয়া, যক্ষা,শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব, নানা ধরনের সংক্রামক ও স্বোপার্জিত (অর্জিত) কারণে ব্রঙ্কিএকটেসিস হতে পারে। তবে সিসটিক ফাইব্রোসিসের কারণে প্রায় সব রোগী কঠিন ব্রঙ্কিএকটেসিসে আক্রান্ত হয়। তবে সিসটিক ফাইব্রোসিস ছাড়া ১০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীর ব্রঙ্কিএকটেসিসের কারণ জানা যায় না। পূর্বে বলা হয়েছে, শ্বাসনালী অতিরিক্ত স্ফীত হওয়ার কারণে ব্রঙ্কিএকটেসিস হয়ে থাকে। বিজড়িত শ্বাসনালী স্ফীত হওয়ার কারণে ফুসফুসে বস্তুরস সঠিকভাবে বের হতে না পারার কারণে ফুসফুসে জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও শ্বাসনালী আটকে পড়ে এবং এর ফলে আরো বেশি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমুনারি ডিজিজ (সিওপিডি) এবং এ্যাজমার মত ব্রঙ্কিএকটেসিসকেও অবসট্রাকটিভ লাং ডিজিজ বলা হয়। কনজেনিটাল (জন্মগত বা স্বভাবগত) এবং একোয়ার্ড (সংসর্গ এবং অভ্যাসগত) উভয় কারণেই ব্রঙ্কিএকটেসিস হতে পারে। তবে একোয়ার্ড কারণেই ব্রঙ্কিএকটেসিস বেশি হতে দেখা যায়।
ডাঃ আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্য পরামর্শ বিষয়ক বই আসুন সুস্থ থাকি
একোয়ার্ড বা (সংসর্গজনিত) কারণ:
ব্রঙ্কিএকটেসিসের সংসর্গজনিত কারণসমূহের মধ্যে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, নিঃশ্বাসের সাথে বহিরাগত কোন বস্তুর প্রবেশ, এলার্জিক ব্রঙ্কোপালমুনারি এবং এসপারজিলোসিস (এক ধরণের ফাঙ্গাস) এবং শ্বাসনালীর টিউমার বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নানা ধরনের জীবাণু ঘটিত সংক্রমের কারণেও ব্রঙ্কিএকটেসিস হতে পারে। যাদের মধ্যে স্টেফাইলোকক্কাস, বরটিটেলা ও হুপিং কাশির জীবণু উল্লেখযোগ্য। বিশ্বাসের সাথে এমোনিয়া এবং অন্যান্য ধরনের বিষাক্ত গ্যাসের প্রবেশ, পালমুনারি এসপিরেশন (খাদ্যনালী থেকে কোনো বস্তুর ফুসফুসে প্রবেশ) মদ্য পানে আসক্তি, হেরোইন জাতীয় মাদক গ্রহণ এবং বিভিন্ন ধরনের এলার্জি ব্রঙ্কিএকটেসিসে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এছাড়া নানা ধরনের ইমুনোলজিক্য উপাদান ও জীবনযাপন পদ্ধতি ও ব্রঙ্কিএকটেসিসে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
কনজেনিটাল বা জন্মগত কারণ: জন্মগতভাবে শ্বাসনালীর কিছু ত্রুটি থাকার কারণে ব্রঙ্কিএকটেসিস হতে পারে। সিসটিক ফাইব্রোসিস এর অন্যতম কারণ। জন্মগত ভাবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদেরও ব্রঙ্কিএকটেসিস হতে পারে।
রোগ নির্ণয়: সাধারণ সন্দেহের ভিত্তিতে ও রোগীর বর্তমান লক্ষণাদি দেখে ব্রঙ্কিএকটেসিস নির্ণয় করা হয়। তবে কম্পিউটার টমোগ্রাফির মাধ্যমে এ রোগ নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যায়। ব্রিটিশ থোরাকিক সোসাইটি নন সিসটিক ফাইব্রোসিস সম্পর্কিত ব্রঙ্কিএকটেসিস নির্ণয়ের টোমোগ্রাফি করার সুপারিশ করে থাকে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় স্পুটাম কালচার উপকারে লাগতে পারে এবং এটা বছরে ১ বার করানো উচিত। এছাড়া রক্ত পরীক্ষা, স্পুটাম কালচার, এক্সরে এবং কখনো কখনো নির্দিষ্ট জেনেটিক গোলযোগ পরীক্ষা করেও ব্রঙ্কিএকটেসিস নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা: সংক্রমনের কারণে রোগের ক্রমাবনতি ঘটলে এমোক্সাসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক এবং এলার্জিক রোগীদের এরিথ্রোমাইসিন অথবা ডক্সিসিলিন জাতীয় এন্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া শ্বাসনালী পরিষ্কার করার জন্য এক ধরনের ফিজিওথেরাপি নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। শ্বাসনালী বড় করার ঔষধ প্রয়োগে কোনো কোনো রোগীর উপকার হলেও এর সার্বিক ফলাফল খুব ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়নি। যাদের অসুখন অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় চলে গেছে তাদের ক্ষেত্রে ফুসফুস ট্রান্সপ্লান্ট করা একটা উপায় হতে পারে। ব্রঙ্কিএকটেসিস চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ব্রঙ্কিয়াল সিক্রেশন নিয়ন্ত্রন, শ্বাসনালীর বাঁধাসমূহ দূরকরণ ও সার্জারি মাধ্যমে ফুসফুসে আক্রান্ত অংশ অপসারণ এবং জটিলতা প্রতিরোধ। এ্যান্টিবায়োটিকের দীর্ঘ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষতিকর সংক্রমণ প্রতিরোধ। অঙ্গ বিন্যাসের মাধ্যমে জমাকৃত কফ নিষ্কাশন,স্থানীয় ব্রঙ্কিএকটেসিস চিকিৎসায় সার্জারি মাধ্যমে বাঁধা সমূহ অপসারণ ইত্যাদি। কফ নিয়ন্ত্রনে গ্যাসীয় আকারের স্টেরয়েড দেয়া যেতে পারে যা, শ্বাসনালীর সংকোচন দীর্ঘদিন যাবত রোধ করে। এ ধরনের একটি কার্যকর স্টেরয়েড হচ্ছে বেকলোমিটাসন। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এটা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা অনুচিত।
প্রতিরোধ:
ব্রঙ্কিএকটেসিস প্রতিরোধে শিশুদের হাম, হুপিং কাশি, নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ রোগের টিকা দেওয়া উচিত। ধূমপানের সাথে ব্রঙ্কিএকটেসিস সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলে ফুসফুসের যে কোনো ধরনের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার জন্য ধূমপান পরিহার করা উচিত। ব্রঙ্কিএকটেসিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শ্বাসনালীর মধ্যে যাতে কিছু আটকে থাকতে না পারে সে ধরনের চিকিৎসা নেয়া উচিত।
আরো পড়ুন যক্ষ্মার
ঝুঁকি কাদের বেশি
No comments