শহরাঞ্চলে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ- সফলতা, ব্যর্থতা এবং করণীয় || Tuberculosis control in urban areas – successes, failures and what to do || Dr. Abida Sultana
যক্ষ্মা একটি ঘাতক ব্যাধি কিন্তু এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়মিত চিকিৎসায় নিরাময় হয়। গত দুই দশক ধরে বিশ্বব্যাপী ডটস (ডাইরেক্টলি অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট শর্ট কোর্স অর্থাৎ সরাসরি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঔষধ খাওয়ানো) পদ্ধতির চিকিৎসা শুরু হলেও যক্ষা এখনো বিশ্বের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ইতিমধ্যে বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের শরীরে যক্ষ্মাজীবণুর সংক্রমণ ঘটেছে। তবে যক্ষ্মাজীবণুর সংক্রমণ ঘটার অর্থ যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হওয়া নয়। এদের মধ্যে প্রতিবছর সারা বিশ্বে আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০ লক্ষ্য যক্ষ্মা রোগী সৃষ্টি হয় এবং নারী-পুরুষ ও শিশু সহ ১৮ থেকে ৩০ লক্ষ লোক এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, উন্নত বা ধনী বিশ্বের জন্য যক্ষ্মা তেমন কোনো গুরুত্ব সামাজিক সমস্যা নয়। এটা মূলত উন্নয়নশীল বিশ্বের গরীব ও প্রান্তিক গরীব মানুষের সমস্যা। যদি ও কখনো কখনো ধনীর লোকেরা ও এ রোগে আক্রান্ত হয়। সারাবিশ্বের প্রতি বছর যত লোক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয় তাদের শতকরা ৯৫ ভাগ এবং যত লোক মৃত্যুবরণ করে তাদের শতকরা ৯৮ ভাগই উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি যক্ষ্মা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে যক্ষ্মারোগীর আনুমানিক সংখ্যা ৫ লক্ষ ৫৯ হাজার (প্রতি লাখে ৩৯১ জন) এর মধ্যে ফুসফুসে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা শতকরা ৮৫ ভাগ। এদের মধ্যে যাদের কফে যক্ষ্মা জীবাণু রয়েছে মূলত তারাই প্রতিনিয়ত হাঁচি কাশির মাধ্যমে এ রোগ ছড়াচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের ৩ লক্ষ ২১ হাজার ৬৭৫ জন নতুন যক্ষ্মা রোগীর সৃষ্টি হয় (প্রতি লাখে ২২৫ জন) এর মধ্যে সংক্রামক যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৩৯৭ জন ( প্রতি লাখে ১০১জন)। প্রতিবছরের এ রোগে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ (প্রতি লাখে ৪৫ জন)। বাংলাদেশ মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (এমডিআর) যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা নতুন নিবন্ধিত যক্ষ্মা রোগীর বেলায় ৩.৬ শতাংশ এবং পুনর্চিকিৎসিত রোগীর (প্রথম বার চিকিৎসা নেওয়ার পরেও যারা রোগ মুক্তি হয়নি) বেলায় ১৯ শতাংশ।
এমডিআর যক্ষ্মা রোগী বলতে সেইসব যক্ষ্মা রোগীকে বোঝায়, অনিয়মিত ঔষধ সেবনের ফলে যাদের যক্ষ্মা রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রধান দুইটি ঔষধ (আইএনএইচ এবং রিফামপিসিন) অথবা সবগুলো ঔষধে আর কোন কাজ হয় না। এছাড়া বাংলাদেশ এক্সট্রিমী মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (এক্সডিআর) রোগীর ও সন্ধান পাওয়া গেছে। এমডিআর যক্ষ্মা রোগীরদের যে সব সেকেন্ড লাইন ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয় এক্সডিআর রোগীদের সেসব ঔষধে আর কাজ হয় না। অর্থাৎ তাদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো আর কোন কার্যকর ঔষধ বাজারে নেই। বাংলাদেশ এক্সডিআর রোগীর সংখ্যা কত তার কোন হিসাব নেই। এক্সডিআর রোগীদের শেষ নিয়তি মৃত্যু। বাংলাদেশের রোগী শনাক্তকরণে হার কফে জীবাণুযুক্ত রোগীর ক্ষেত্রে শতকরা ৭১.৫ ভাগ এবং সব রোগীর ক্ষেত্রে শতকরা ৪৬ ভাগ। রোগ নিরাময়ের হার কফে জীবণু যুক্ত নতুন নিবন্ধিত রোগীর ক্ষেত্রে শতকরা ৯২ ভাগ। বিশ্বের যে ২২ টি দেশে যক্ষ্মা রোগের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিশ্বের ষষ্ঠ যক্ষ্মারোগ ভারাক্রান্ত দেশ। বাংলাদেশের সমগ্র অঞ্চল এখন ডট পদ্ধতির চিকিৎসার আওতাভুক্ত।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গরীব ও প্রান্তিক গরীব মানুষের যক্ষ্মা রোগের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে নারী- পুরুষের অনুপাত সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও চিকিৎসার জন্য নিবন্ধিত নতুন স্পুটাম পজেটিভ (কফে জীবাণু আছে এমন রোগী রোগীর) রোগীর তালিকা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত নারী পুরুষের অনুপাত ০.৪ অর্থাৎ ২:৫। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে বহির্বিভাগে আগত মহিলা রোগী এবং মহিলা রোগীদের কফ পরীক্ষার সংখ্যা আগত পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যক্ষ্মা রোগীর অনুপাত সম্পর্কে কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই তবে অস্বাস্থ্যকর ও দূষিত পরিবেশের যক্ষ্মা রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটে এমন ধারণা থেকে অনেকে মনে করেন গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বেশি। এ ধারণা সঠিক নয় বলে অন্যরা দাবি করেন। কারো কারো ধারণা বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সমান সমান।
ডাঃ আবিদা সুলতানার স্বাস্থ্য পরামর্শ বিষয়ক বই আসুন সুস্থ থাকি
কিন্তু জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ (এনটিপি) কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তার সাথে উপরে বর্ণিত ধরণার কোন মিল নেই। ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০৭ সালে সারাদেশের সর্বমোট ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬১৭ জন যক্ষ্মা রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ২৭ হাজার ৫২৫ জন রোগীকে যা ম মোট রোগীর মাত্র ১৮.৫২ শতাংশ।
এই চিত্র দুটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। প্রথমত, গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে নিবন্ধিত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা অনেক কম। দ্বিতীয়ত শহর অঞ্চলের চিকিৎসিত যক্ষ্মা রোগীদের সম্পূর্ণ হিসাবে এখানে অনুপস্থিত এবং এই দ্বিতীয় অনুমানটি সঠিক বলে আমি মনে করি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক কয়েকটি দেশে পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, যক্ষ্মাসহ সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত সব রোগীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য প্রথমে প্রাইভেট চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয় এবং তারাই প্রাথমিক পর্যায়ে এসব রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করেন। এ কারণেই যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসাউ প্রাইভেট চিকিৎসকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকারি/ এনজিওদের (যেসব এনজিও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে) মত প্রাইভেট চিকিৎসা খাতে রোগীর নিবন্ধন রেকর্ডিং, রিপোর্টিং ও ফলোয়ার ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা যত রোগীর চিকিৎসা করেন তার কোন হিসাব সরকারি হিসাবের মধ্যে যুক্ত হয় না। এ কারণেই শহর অঞ্চলের চিকিৎসা গ্রহণকারী নিবন্ধিত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা এত কম।
ঢাকা শহরে একটি ওয়ার্ডে পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, ওই ওয়ার্ডের রেজিস্টার্ড প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারের সংখ্যা ৫৯ জন। এর মধ্যে ৪৫ জন জেনারেল প্র্যাকটিশনার এবং বাকি ১৪ জন দাঁত, নাক, কান, গলা, গাইনী, চক্ষু রোগের চিকিৎসক। এক বছরে ঐ ওয়ার্ডে এই ৪৫ জন চিকিৎসক মোট ১৭২ জন যক্ষ্মা রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন। এর মধ্যে স্পুটাম পজেটিভ রোগী সংখ্যা ৬৪ জন। এর ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায় ঢাকা শহরের রেজিস্টার্ড প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার এবং জেনারেল প্র্যাকটিশনারের সংখ্যা ৪ হাজারের উপরে। এরা বছরে আনুমানিক গড়ে ১৫০০০ যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা করেন যাদের মধ্যে স্পুটাম পজিটিভ রোগীর সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এর সাথে ঢাকা শহরের যক্ষ্মা ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন, জেলা ও পৌর এলাকার প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার এবং তাদের চিকিৎসকৃত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা যুক্ত হলে এই সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে ডটস পদ্ধতির চিকিৎসা শুরু হওয়ার দেড় যুগ পরেও শহরাঞ্চলে যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার কোনো প্রকৃত তথ্যই আমরা জানিনা। এভাবে প্রতিবছর শহরাঞ্চলে চিকিৎসা গ্রহণকারী যক্ষ্মা রোগীদের একটি বিপুল অংশ সরকারি হিসাবের বাইরে থেকে যায়।
এটা চিত্রের এক দিক। এই চিত্রের অন্যদিকের দৃশ্য আরক ভয়াবহ। সরকারের সাথে প্রাইভেট চিকিৎসকদের তেমন কোন যোগাযোগ না থাকার কারণে সরকারের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রাইভেট চিকিৎসকদের ধারণা খুবই অস্পষ্ট। ঢাকা শহরে পরিচালিত অন্য একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রাইভেট প্র্যাকটিশনাররা এস.জি.পি.টি., ক্রিটিনিন, রক্তে সিবিসিসি সহ এমন অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করান যার সাথে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের কোন বাস্তব সম্পর্ক নেই। শুধু রোগ নয়, চিকিৎসার ক্ষেত্রেও তারা সরকারি নীতিমালা সঠিকভাবে মেনে চলেন না। ওই সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ৭০ শতাংশ প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারের যক্ষ্মা রোগ চিকিৎসার মেয়াদকাল সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা নেই। যেহেতু প্রাইভেট সেক্টরে রোগী নিবন্ধন, রেকর্ডিং ও ফলোআপের কোনো ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে সেহেতু চিকিৎসকৃত রোগীদের শতকরা কত ভাগ নিরাময় লাভ করেছে, কত ভাগ রোগী নিয়মিত চিকিৎসা নেয়নি, কত ভাগ নিরাময় লাভ করেন এবং কত ভাগ রোগী অনিয়মিত চিকিৎসার কারণে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়েছে, তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। রোগী নিবন্ধন রেকর্ডিং ফলো রিপোর্টিং এবং ফলো আপের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সরকারি খাতের নিবন্ধিত নতুন ও রিট্রিটমেন্ট রোগীদের মধ্যে এম.ডি.আর( মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) রোগীর হার যেখানে যথাক্রমে ৩.৬ ও ১৯ শতাংশ, সেখানে এই ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এম.ডি.আর রোগীর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে, তা নিশ্চিত করে বলাই যায়।
আরো বিপদের কথা হল, এমডিআর রোগী সংস্পর্শে এসে যেসব নতুন যক্ষ্মা রোগীর জন্ম হয়েছে তারা এমডিআর যক্ষ্মা রোগী হয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদের অজান্তে একটি সুন্দর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের আওতায় এভাবে প্রতিনিয়ত এমডিআর যক্ষ্মা রোগীর হার বাড়ছে- তা প্রতিরোধ করতে না পারলে অচিরে এমন এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে যা আমরা কল্পনা করতে পারছিনা। সাধারণ যক্ষ্মা রোগীর তুলনায় এমডিআর যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ।
তাছাড়া ডোমিসিলিয়ারী (হাসপাতালের বদলে রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা) পদ্ধতিতে এমডিআর যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসাতে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যায় না। এজন্য রোগীকে অন্তত প্রথম তিন মাস হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার পর কঠোর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেওয়াই উত্তম। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে যত এমডিআর রোগীর সৃষ্টি হয়েছে এবং এর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সেই রোগীদের হাসপাতালে রেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যত সংখ্যক হাসপাতালের প্রয়োজন সেই অনুপাতে আমাদের হাসপাতাল সমূহে জায়গা কোথায়? এছাড়া বর্তমানে এমডিআর রোগীদের যে অতি ক্ষুদ্র অংশকে হাসপাতালে রেখে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর বিভিন্ন ডটস সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে, সেখানে তারা ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা এবং পৌঁছে থাকলে তাদের যথাযথ তদারকির মাধ্যমে ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে কি ঘটছে, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। এইচ. আই. ভি / এইডস এখনো বাংলাদেশের জন্য তেমন কোন বড় সমস্যা নয়। তবে বাংলাদেশ এইডস ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কোনো কারণে যদি দেশে এইডস ছড়িয়ে পড়ে তবে প্রথমে তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে যক্ষ্মা রোগীর উপর। দেশে যক্ষ্মা রোগীদের অধিকাংশই মারা পড়বে এইডস এর কারণে। এজন্য সব দিক থেকে নিরাপদ হলেও দেশে এমডিআর রোগী যাতে সৃষ্টি না হয়, সেই ব্যবস্থা করা।
এটা করতে হলে ওর অনতিবিলম্বে শহরাঞ্চলে পিপিএম -ডটস (পাবলিক প্রাইভেট মিক্সড ডটস) চালুর মাধ্যমে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। পিপিএম- ডটস এর মাধ্যমে শহরাঞ্চলে কোয়ালিফাইড ও নন কোয়ালিফাইড সকল প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারদের ক্রমান্বয়ে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। তাদের সবাইকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকান্ড অবহিত করার মাধ্যমে সরকারি ও প্রাইভেট সেক্টরে অভিন্ন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করার ব্যবস্থা সহ প্রাইভেট সেক্টরের রোগীর নিবন্ধন, রেকর্ডিং ও ফলোআপের ব্যবস্থা চালু করতে হবে যাতে সারাদেশে যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার একটি সঠিক ও নির্ভরযোগ্য চিত্র পাওয়া যায়। কিভাবে এটা করা সম্ভব, তা প্রাইভেট চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় যক্ষ্মা রোগী চিকিৎসার জন্য যেসব ডটস সেন্টার চালু করা হয়েছে তাদের কর্মকাণ্ড খুবই দুর্বল। এলাকার প্রাইভেট প্র্যাকটিশিনারদের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ৭০ শতাংশ প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার এসব ডটস সেন্টারে অবস্থান ও কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানেনা। তাছাড়া এসব ডটস সেন্টার এর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা ততদারকির জন্য কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাও নেই। ওই সমীক্ষা থেকে আরো দেখা গেছে যে, স্থানীয় চিকিৎসকদের সাথে ডটস।সেন্টারে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং সঠিক তদারকি থাকলে এদের নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের ও বেশি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
রেজিস্ট্যার্ড প্রাইভেট প্র্যাকটিশনারদের পাশাপাশি সেবা দানকারী অন্যান্য চিকিৎসক যেমন: হোমিওপ্যাথ, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী ও গ্রাম্য ডাক্তার এবং চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত বিধায় ফার্মাসিস্টদের ও এ কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা দরকার। কারণ সমাজের বৃত্তহীন মানুষ যে কোনো শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রথমেই চিকিৎসা বা পরামর্শের জন্য এদেরই শরণাপন্ন হয়। এদেরকে যক্ষ্মা রোগ, যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা এবং চিকিৎসা প্রাপ্তির স্থান সম্পর্কে অবহিত করতে হবে যাতে তারা সন্দেহভাজন যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সঠিক উপদেশ ও সঠিক স্থানে পাঠাতে পারেন।
যক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সমাজে বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবী যেমন: কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, স্থানীয় যুব /মহিলা সংগঠন ক্লাবের প্রতিনিধিদের ও এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা প্রয়োজন। যাতে প্রতি এলাকা যক্ষ্মা রোগ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সঠিক ধারণা গড়ে ওঠে।
আমি মনে করি যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আর দেরি না করে শহরাঞ্চলে পিপিএম -ডটস পদ্ধতি চালু করা একান্ত অপরিহার্য। ইতিমধ্যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এটা চালু করতে না পারলে আমাদের সকলের সামনে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের নামে দেশে এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যার হাত থেকে আমরা কেউই রেহাই পাব না। এর সম্পূর্ণ দায়- দায়িত্ব তখন সরকারকেই বহন করতে হবে।
আরো পড়ুন যক্ষ্মার ঝুঁকি কাদের বেশি
শহরাঞ্চলে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ- সফলতা, ব্যর্থতা এবং করণীয় || ডাঃ আবিদা সুলতানাTuberculosis control in urban areas – successes, failures and what to do || Dr. Abida Sultana
আর্টিকেলটি
ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
আর্টিকেলটি
ভালো লাগলে শেয়ার করে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
No comments